সালেহ আহমদ (স'লিপক) : মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার পৌর এলাকার ১নং ওয়ার্ডস্থ করিপুর এবং কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের রামপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ধলাই নদী। কোনো পাঁকা সেতু না থাকায় নদীর ওপর নির্মিত অস্থায়ী বাঁশের সাঁকো দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আশেপাশের ১৫ থেকে ২০টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষজন যাতায়াত করেন।
এসব এলাকায় বসবাসকারীরা উপজেলা সদরে পৌঁছাতে হলে ঘুরে আসতে হয় ৫ থেকে ৮/১০ কিলোমিটার সড়কপথ। অথচ এ স্থানে একটি ব্রিজ নির্মিত হলে সেখান থেকে উপজেলার দূরত্ব দাঁড়ায় মাত্র দেড় থেকে দুই কিলোমিটার। পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড করিমপুর ও গোপালনগর গ্রামের সাথে সদর ইউনিয়নের যোগাযোগের একমাত মাধ্যম হলো খেয়াঘাট হয়ে এই সড়কটি। এই সহজ যোগাগের একমাত্র বাধা হচ্ছে ধলাই নদী।
সড়ই বাড়ি, বাদে উবাহাটা, ছতিয়া, চৈতন্যগঞ্জ, নারায়নপুর, রামপুর, রামপাশা, সাইয়াখালি গ্রামগুলো ছাড়া পৌরসভার আরো ৭ থেকে ১০টি গ্রামের লোকজন এ সাঁকোটি ব্যবহার করে থাকেন।
বাঁশের সাঁকো দিয়ে প্রতিদিন পারাপারে দূর্ভোগ পোহাচ্ছে ১৫টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। যুগের পর যুগ ধরে তাদের একমাত্র ভরসা একটি বাঁশের সাঁকো। একটিমাত্র ব্রিজের অভাবে হাজার হাজার মানুষের যাতায়াতে ঘটছে চরম ব্যাঘাত। তাদের যাতায়াতের একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে খড়া মৌসুমে ঝুঁকিপূর্ণ একটি বাঁশের সাঁকো আর বর্ষা মৌসুমে নিরাপত্তাহীন খেয়া নৌকা। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে শহরের সাথে এসব এলাকার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় এলাকাবাসী চরম হতাশা ও দূর্ভোগে পড়েন।
সাঁকোটি পারাপার হতে গিয়ে শতাধিক লোক হতাহত হয়েছেন। কেউ কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমে প্রতিবছর খড়া মৌসুমে বাঁশের সাঁকো তৈরি করেন আবার বর্ষা মৌসুমে তা পানিতে তলিয়ে যায়। প্রতিদিন বাঁশের তৈরি এ সাঁকোর উপর দিয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, গর্ভবতী মহিলা, অসুস্থ রোগী সহ সকল শ্রেণীপেশার মানুষ পারাপার হন। বিশেষ করে কৃষি কাজের জন্য নদীর দু’পাড়ের মানুষ নিয়মিত যাতায়াত করতে হয়।
সরেজমিনে গেলে এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী হামিদা আক্তার সুমাইয়া বলেন, ভানুগাছ হয়ে ঘুরিয়ে যেতে হয় বলে আমরা এদিকে স্কুলে যাই। ভয়ে ভয়ে সাঁকো পার হই। যাতায়াতে বিঘ্নতার জন্য প্রায়ই স্কুল বাদ দেই আমরা।
শিক্ষার্থী রুকশানা বলেন, আমরা বড়রা মোটামুটি কষ্টকরে সাঁকো পেড়িয়ে যেতে পাড়ি। ছোটরা পারেনা। সাঁকোর বাঁশ ভাঙ্গা থাকায় ভয়ে থাকি, কখন পড়ে যাই! কেউ কেউ পড়ে গিয়ে কাপড় ভিজিয়ে বাড়িতে ফেটৎ যায়। প্রায়ই স্কুলে যাওয়া হয়না। নিতান্তই যেতে হলে ভানুগাছ বাজার ঘুরে যেতে হয়। তাই প্রায়ই সময়মতো স্কুলে যেতে পারিনা। অনেকে প্রাইভেট কোচিং ক্লাসও মিস করে।
স্থানীয়রা বাসিন্দাদের সাথে আলাপকালে গৃহিণী আমিরুন বলেন, প্যাগনেট মহিলারা অনেক কষ্ট করে হাসপাতালে যেতে হয়। সবসময় গাড়ি পাওয়া যায় না। আমরা বড় কষ্টে আছি।
ছেলেকে নিয়ে সাঁকো পার হওয়া দিলারা বেগম বলেন, ছেলে মৌলভীবাজার যাচ্ছে। তার বাবা সাঁকো পারাপারে ভয় পান তাই এগিয়ে দিতে এসেছি। নদীর পাড়ে থাকি, সাঁকো পারাপারে অভ্যাস হয়ে গেছে। তবুও মাঝে মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে।
করিমপুরের কামাল চৌধুরী ও আনোয়ার হোসেন অভিন্ন সুরে বলেন, জেলা বোর্ডের সড়ক থেকে প্রায় দেড়শো ফিট দুরে ধলাই নদী। শীত মৌসুমে সাঁকো দিয়ে মানুষজন থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, গণ মহাবিদ্যালয়ে যাতায়াত করে। যাতায়াতে অনেক বিঘ্নতা ঘটে। এসময় ছোটখাটো অনেক দুর্ঘটনাও ঘটে। সাকোঁ দুর্ঘটনায় অনেকেই পঙ্গু হয়েছেন।
রামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এর প্রধান শিক্ষক ইসমাইল হারুন বলেন, আমার স্কুলের পাশ দিয়ে ধলাই নদী চলে গেছে। শেখ মৌসুমে নদীটি শুকিয়ে যায়। আর বর্ষা মৌসুমে মানুষজন নৌকায় আসা যাওয়া করে। আমি সাঁকো পার হতে পারি না। তাই শীত মৌসুমে অন্যদিকে আসা যাওয়া করি। আর বর্ষায় এদিকে নৌকার আসা যাওয়া করি। যদি এখানে ব্রিজ হয়, তাহলে সবার জন্য ভালো হয়।
স্থানীয়রা জানান, বর্ষাকালে পানি বেড়ে গেলে নৌকা বন্ধ থাকে। সাঁকো বছরে দুইবার মেরামত করা লাগে। কার্তিক মাসে সাঁকো তৈরি করা হয় এবং বর্ষাকালে পানি বেড়ে গেলে সাঁকো ভেঙ্গে পড়ে। তখন আবার গ্রামের মানুষদের কাছ থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে সাঁকো মেরামত করা লাগে। দেশ স্বাধীনের পর থেকে এখানে একটি ব্রিজ এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি হওয়ার পরেও আজ পর্যন্ত ব্রিজ নির্মাণ তো দূরের কথা কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে এই খেয়াঘাটে একটি ব্রিজ নির্মাণের দাবি জানালেও দাবিটি বারবারই উপেক্ষিত।
কমলগঞ্জ পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেওয়ান আব্দুর রহিম মহিন বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই এখানকার মানুষ সাঁকো দিয়েই পারাপার হচ্ছেন। সাঁকোর এপাড় পৌরসভা এবং ওপাড় সদর ইউনিয়ন। ইউনিয়নে প্রায় সাতটি গ্রাম আর পৌরসভায় আছে গোপালনগর ও করিমপুর দুইটি গ্রাম। বর্ষায় পারাপারের একমাত্র উপায় নৌকা। নদী যখন ভরপুর থাকে তখন নৌকায় পারা পারো রিক্স হয়ে যায়। একটা রোগী হাসপাতালে আসতে ঘুরে আসতে হয়। যদি এখানে ব্রিজ হয় তাহলে কিলোমিটার দূরেই হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে পারে। অনেক সময় রোগীরা হাসপাতলে সময়মতো পৌঁছাতে না পেরে মারা যান।
কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান বলেন, রামপুর এবং করিমপুরের সাথে ধলাই নদীর উপরে একটি ব্রিজ খুবই জরুরী। এখানে বর্তমানে মানুষ বাঁশের সাকোঁ দিয়ে পারাপার হয়। অনেক আগেই এলজিডির মাধ্যমে আমরা একটা প্রস্তাবনা করেছি। এই রাস্তা দিয়ে সাঁকো পারাপর হয়ে ছয়-সাত গ্রামের মানুষ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং সদরে যাতায়াত করে থাকেন। অনতিবিলম্বে এখানে একটি ব্রিজ হওয়ার জন্য সবার সহযোগিতা না করছি।
কমলগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জুয়েল আহমেদ বলেন,
আমাদের করিমপুরে ধলাই নদীর উপরে যাতায়াতের যে ব্যবস্থা সেখানে সাঁকো দিয়ে সনাতন ধর্মালম্বী মানুষ, স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী এবং গর্ভবতী মা বোনেরাও যাতায়াত করছেন। এখানে একটি ব্রিজ নির্মাণ হলে প্রায় ১৪/১৫টি গ্রামের লোক উপকৃত হবে। শহরগামী, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও হাসপাতালগামী মানুষের কষ্ট অনেকটা লাঘব হবে। কিন্তু যেখানে ব্রিজ নির্মাণের কথা দাবী উঠেছে, সেই জায়গাটা কিন্তু কমলগঞ্জের সদর ইউনিয়ন এবং মুন্সিবাজার ইউনিয়নের মিলনস্থল।
কমলগঞ্জ উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী মোঃ জাহিদুল ইসলাম জানান, আমাদের একটি প্রকল্প আছে উপজেলা সড়ক ও ইউনিয়ন গ্রাম সড়ক দীর্ঘ ১০০ মিটার ব্রিজ প্রকল্প। সেটাতে রামপুর ও করিমপুর ধলাই নদীর উপরে আমরা বর্মান কৃষিমন্ত্রীর নির্দেশনায় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি।