
সর্বস্তরের জনগণকে টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে প্রাথমিকভাবে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা- এই চার স্কিম নিয়ে সরকার সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করেছে। শুরুতেই সর্বজনীন পেনশনে মানুষের ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিনই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা পরিশোধ করছেন। এরই মধ্যে পেনশনের আওতায় আসা ব্যক্তিরা তিন কোটি টাকার ওপরে চাঁদা জমা দিয়েছেন।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর পর এ নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে এই স্কিম নিরাপদ কি না, চাঁদার টাকা কী করা হবে, নিজেদের কষ্টের টাকায় পরিশোধ করা চাঁদার পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন কি না- এমন কিছু প্রশ্নও করছেন অনেকে। তবে এই পেনশন স্কিম যে নিরাপদ এবং নাগরিকদের কল্যাণেই যে তা ব্যবহৃত হবে- তা নিশ্চিত করেছে সরকার।
পেনশনের আওতায় আসাদের জমা দেওয়া এই চাঁদা ঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ খাতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে এই টাকা কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করা হবে, তা এখনো ঠিক করা হয়নি। এ লক্ষ্যে একটি বিনিয়োগ নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এই নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। নীতিমালা তৈরি হয়ে গেলে সেই অনুযায়ী পেনশন স্কিমের টাকা বিনিয়োগ করা হবে।
অবশ্য এই বিনিয়োগ নীতিমালা তৈরির আগেই প্রাথমিকভাবে জমা হওয়া চাঁদার টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সরকারি সিকিউরিটিজে বা ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, সরকার চাচ্ছে যারা পেনশন স্কিম গ্রহণ করে চাঁদা দেওয়া শুরু করবেন, তারা যেন তা মেয়াদ পূর্ণ পর্যন্ত চালিয়ে যান। এজন্য স্কিম পরিবর্তন এবং চাঁদা বকেয়া পড়লে তা পরবর্তীতে পরিশোধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এরপরও যদি কেউ মেয়াদ পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত চাঁদা দিতে না পারেন, তাহলেও মুনাফাসহ জমা দেওয়া অর্থ ফেরত পাবেন।
এমনকি চাঁদার এক কিস্তি দেওয়ার পর যদি আর না দেন তাহলেও তিনি মুনাফাসহ জমা দেওয়া টাকা ফেরত পাবেন। তবে যখন খুশি তখন চাইলেই টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না। যিনি পেনশন স্কিম গ্রহণ করবেন তার বয়স কেবল ৬০ বছর পূর্ণ হলেই চাঁদার অর্থ মুনাফাসহ ফেরত পাবেন।
সূত্রটি জানিয়েছে, পেনশন স্কিমের আওতায় চাঁদা বাবদ জমা হওয়া টাকা ফেলে রাখলে তা থেকে কোনো মুনাফা আসবে না। এজন্য চাঁদার টাকা বিনিয়োগ করা হবে। কীভাবে এবং কোথায় কোথায় এই অর্থ বিনিয়োগ করা হবে সেজন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। ওই নীতিমালা অনুযায়ী পেনশন স্কিমের টাকা বিনিয়োগ করা হবে। তবে বিনিয়োগ নীতিমালা হওয়ার আগেও এই অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে সরকারি সিকিউরিটিজের মতো নিরাপদ লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা হবে।
এদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পেনশন স্কিমের আওতায় চাঁদা বাবদ জমা হওয়া অর্থ বিনিয়োগের বিষয়টি খুবই চ্যালেঞ্জিং। বিনিয়োগটা ভালো জায়গায় না হলে চালান গায়েব হয়ে যাবে। এটা অবশ্যই ভালো রিটার্ন পাওয়া যাবে- এমন খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি বন্ড, ভালো কোম্পানির বন্ড এবং পুঁজিবাজারের ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। পাশাপাশি পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্পে অথবা এ ধরনের প্রকল্পের বন্ডে বিনিয়োগ করা যেতে পারে।
পেনশনের চাঁদার টাকা কোথায় বিনিয়োগ করা হবে- জানতে চাইলে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা জাগো নিউজকে বলেন, ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। এই জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ অ্যাডমিনিস্ট্রেট (পরিচালনা) করবে। সেখানে একটা বোর্ড আছে, বোর্ড গাইডলাইন তৈরি করবে এবং আমরা একটা বিনিয়োগ বিধিমালাও তৈরি করবো। সেটার কাজ চলছে।’
তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগ ছাড়া চলবে কীভাবে? বিনিয়োগ করতেই হবে। আমরা চাচ্ছি খুব দ্রুত বিনিয়োগ করতে। আমরা ফান্ড পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগের উদ্যোগ নেবো। গাইডলাইন তৈরির আগে যদি আমি সরকারি কোনো...(খাতে) বিনিয়োগ করি তাতেও সমস্যা নেই। যেমন আমি যদি ট্রেজারি বিল কিনি, ট্রেজারি বিলের থেকে নিরাপদ তো কিছু নেই। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে ট্রেজারি বিল কিনবো, তাতে কোনো সমস্যা নেই। তবে এখানে একটা প্রভিশন রাখা হয়েছে, তা হলো নিরাপদ বিনিয়োগের বাইরে আমরা কোনো বিনিয়োগ করবো না।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্ট ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মনে করি উদ্যোগটা (সর্বজনীন পেনশন) প্রশংসনীয়। তবে কথা হচ্ছে কাভারেজ কতটুকু হয়। কেননা, যারা ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করে তারা কি প্রিমিয়াম দিতে পারবে? প্রিমিয়াম দিতে না পারলে এর আওতায় আসতে পারবে না। তারপর এই ফান্ড ফাইন্যান্সিং হয়, নাকি এখানে আবার সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। এসব কতগুলো বিষয় আছে।’
ফান্ডের টাকা কোথায় বিনিয়োগ করা যেতে পারে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু বিনিয়োগ করে যাতে ফান্ডটা সেভ ফাইন্যান্সিং হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। বিনিয়োগটা যাতে লাভজনক হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিনিয়োগ থেকে যেন অবশ্যই ভালো রিটার্ন পাওয়া যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে এই ফান্ডের অর্থ বিনিয়োগ করা উচিত হবে কি না- এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সরকারের প্রকল্প থেকে ইনকাম কেমন আসবে সেটা দেখতে হবে। সব প্রকল্প থেকে তো ইনকাম আসে না। পদ্মা সেতু থেকে ইনকাম হচ্ছে, কিন্তু অনেক প্রকল্প থেকে তো ইনকাম হয় না। এগুলো দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘সর্বজনীন পেনশন সরকার চালু করেছে ঠিকই, কিন্তু এটার পরিচালন ব্যবস্থা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, বিনিয়োগ পলিসি, বিনিয়োগ টিম এগুলোর কোনো কিছু ঠিক করা হয়নি। একটা সিস্টেমের মাধ্যমে করা হয়েছে, তবে এটা হিউজ ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট ইস্যু। সেটাও ঠিক করা হয়নি।’
‘বিশেষ করে সমতা অর্থাৎ গরিবদের জন্য যে স্কিম করা হয়েছে, সেখানে কীভাবে সিলেকশনটা হবে? আমি কি অ্যাপ্লাই করলেই আমাকে নেবে? তা তো হওয়ার কথা না। আমাকে তো গরিব হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। সেটা কিসের ভিত্তিতে হবে, সেগুলো বলা হয়নি। কে সার্টিফাই করবে, কিসের ভিত্তিতে? এগুলো না করে এখন যদি আমি দিয়ে দেই তাহলে তো মুসকিল হয়ে যাবে। সরকারকে তো প্রতি মাসে প্রচুর পয়সা দিতে হবে। ফেক অ্যাকাউন্ট থাকতেই পারে, সেগুলো দূর করবো কীভাবে? সুতরাং এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে।’ বলেন বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘একটা বড় অফিস লাগবে। শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকবে। সেখানে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থাকবে। অর্গানোগ্রাম থাকতে হবে। এগুলোর কিছুই করা হয়নি। অফিসটাও ভাড়া করা হয়নি।’
পেনশনের চাঁদার টাকা সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা যায় কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা (ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ) খুব বেশি করা ঠিক হবে না। এতে নিরাপত্তা থাকবে, কিন্তু রিটার্ন সেভাবে আসবে না। কারণ সরকারি সিকিউরিটিজে ৫-৬ শতাংশের মতো মুনাফা পাওয়া যায়। সরকারি বন্ডের সমস্যা হচ্ছে, তা বাজারভিত্তিক না। ব্যাংকাররা রাখে শুধু একটা কারণে, সেটা হলো এসএলআর শর্ত পূরণ করার জন্য, যা পাই তাই ভালো। যা পাই তাই দিয়ে তো আর পেনশন ফান্ড চলবে না। লিকুইডিটি ম্যানেজমেন্ট চলবে।’
পেনশন স্কিমে জমা হওয়া চাঁদা কোথায় বিনিয়োগ করা যেতে পারে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ। আমাদের স্টক মার্কেট খুবই আন্ডার ডেভেলপ, খুবই করাপশন। তবু বলা যায় অল্পকিছু স্টক আছে, যেগুলো রিলায়েবল। স্টক মার্কেটে কিছু বিনিয়োগের সুযোগ রাখা উচিত। এটা পৃথিবীর সব দেশেই রাখে। তবে এই বিনিয়োগ শুধু ট্রিপল ‘এ’ ক্যাটাগরির কোম্পানিতে করার সুযোগ রাখা যেতে পারে, তার বাইরে না।’
পুঁজিবাজারের বাইরে কোথায় বিনিয়োগ করা যেতে পারে? এমন প্রশ্ন করা হলে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। সরকারি বন্ডের কথা যেটা বলা হলো, সেটা করা যেতে পারে। এর বাইরে ভালো কোম্পানি যদি বাজারে বন্ড ছাড়ে, সেখানে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়া সরকার যদি ভালো প্রজেক্ট নিয়ে আসে, সেখানে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। যেমন- দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বা প্রথম পদ্মা সেতু থেকে একটা বন্ড ইস্যু করলো, ৯-১০ শতাংশ মুনাফা দেয়, সেটাতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। তা হলে সরকারও কিছু ফান্ড পেয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগটা ভালো জায়গায় না হলে চালান গায়েব হয়ে যাবে। এটা খুবই চ্যালেঞ্জিং। এই ফান্ড যেন যেনতেনভাবে যেকোনো জায়গায় সরকারের ইচ্ছামতো ব্যয় না হয়। রিজার্ভে যেমন হয়েছে- এই পয়রা বন্দরকে দিয়ে দাও, অমককে দিয়ে দাও। দিয়ে দেখা গেলো ৭ বিলিয়ন ডলার নাই হয়ে গেছে। সেটা করা যাবে না।’
আরেক অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘সর্বজনীন পেনশন খুবই ভালো পদক্ষেপ। এটা সামাজিক নিরাপত্তাকে মাথায় রেখে করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে শুরু করা হয়েছে, দেখা যাক কীভাবে যায়। এমনিতে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। পরে এতে যদি কোনো কিছু সংযোজন করতে হয়, করা যাবে।’
পেনশন স্কিমে জমা হওয়া চাঁদা কোথায় বিনিয়োগ করা যেতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকারি বিনিয়োগ দেশের উন্নয়নের জন্য, সেদিক থেকে এগুলো কোনো ব্যবসায়িক বিনিয়োগ না। এগুলো (পেনশনের চাঁদার টাকা) দেশের উন্নয়নে ব্যবহার হবে। সরকার যেখানে দরকার মনে করবে, সেখানে ব্যবহার করবে। আমি এটাকে অত গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি না।’